অবস্থার ভেতরে ভেতরে হলেও বদল ঘটতে শুরু করেছিল মোটামুটি আটের শেষ বা নয়ের দশকের গোড়া থেকে। এবং তার স্পষ্ট অভিঘাত টের পাওয়া যেতে থাকল একুশ শতকে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে। আন্তর্জালিক দুনিয়া বাঙালি পাঠককে এনে দাঁড় করিয়ে দিল ক্রম-পরিবর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতের ঠিক মধ্যিখানে। মানসিকতায় বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা হয়ত তখনো হতে পারিনি পুরোপুরি, তবু আমাদের ভাবনা তথা দৃষ্টিকোণের ক্ষেত্রে তখন কিন্তু ঘটে যাচ্ছে বিপুল রদবদল। জীবনকে দেখার চোখটাই যেমন তখন বদলে যাচ্ছিল ভেতরে-বাইরে, বিভিন্ন চাপের মুখে পড়ে, তেমনি পুরোনো মূল্যবোধগুলোও একই সঙ্গে সম্মুখীন হচ্ছিল নানা প্রশ্নের, চ্যালেঞ্জের। সব থেকে বড় কথা , ভাঙতে ভাঙতে এতদিনে এসে টের পাওয়া যাচ্ছিল যৌথ পরিবার-ভিত্তিক মানসিকতার গড়নটাই কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নতুন কোনো আঁকড়ে ধরার মতো মনো-সামাজিক অবলম্বন মিলছিল না যেহেতু, ফলে সামাজিক উপরিকাঠামোর চেহারাটাই যত দিন যাচ্ছিল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল বেশ খানিকটা বকচ্ছপ গোছের। এবং বাড়তি মজাটা হল, এর মধ্যেই যেহেতু রক্তের ভেতরে শিকড় গেড়ে থাকা আদ্যন্ত বাঙালি মূল্যবোধকেও টিঁকে থাকার জন্যে অবলম্বন খুঁজতে হচ্ছিল প্রাণপণে, ফলে উপরে উপরে আপাত-ঘটনাহীন জনজীবনের চেহারাটা হয়ত বজায় থাকছিল ঠিকই, কিন্তু তার গড়ন টোকই, কিন্তু তার গড়ন টোল খাচ্ছিল বিস্তর।
পেশায় প্লাস্টিক সার্জেন, নেশায় লেখক অনিরুদ্ধ বসুর জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ কলকাতায়। বি ই কলেজের স্নাতক ইঞ্জিনিয়ার বাবা স্বর্গীয় বিনয়েন্দ্র মোহন বসু ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রৌপ্য পদক প্রাপ্ত বাংলার স্নতাকোত্তর মা স্বর্গীয় ইলা বসুর-র উৎসাহে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ। পরে ইউনাইটেড কিংডমের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেনস থেকে এফ আর সি এস। ইংল্যান্ডে বহু বছর কাটিয়েছে। দু-বছর মধ্য প্রাচ্যেও। এখন কলকাতার প্রখ্যাত প্লাস্টিক সার্জেন। দেশে ও বিদেশে অন্যতমদের মধ্যে একজন।
ছোটবেলা থেকেই লেখায় আসক্তি। স্কুল পত্রিকা ‘নিহিল উল্ট্রার’ সম্পাদক পদের দায়িত্বে থাকাকালীন নিয়মিত সাহিত্যচর্চা। বহু পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি। পরে ইংল্যান্ড ও কুয়েতে সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ।
নিয়তি কেন বাধ্যতে। অনেক সময় নিয়তি বিভিন্ন আঙ্গিকে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ব্যস্ততার মধ্যে ২০০৬ শালে পায়ের হাড় ভেঙে ছ’মাস হুইলচেয়ারে থাকাকালীন সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় পুনরায় লেখালেখি শুরু। সেই সময় ‘অন্বেষণ’ উপন্যাস রচনা। যা প্রকাশিত হয় ২৫ আগস্ট ২০০৭-এ। নতুন আঙ্গিকের এই উপন্যাস সাড়া ফেলে দেয় সংস্কৃতি মহলে। বেস্টসেলার শুধুই হয়নি, ব্যস্ত প্র্যাকটিসের মধ্যেও লেখায় অনুপ্রেরণা জোগায়। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নিঃশব্দে’ ও বেস্টসেলারের খাতায় নাম লেখায়। শুধু তাই নয়, লন্ডন বুক ফেয়ার ও জাতীয় মাধ্যমে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ভবিতব্য নতুন সৃষ্টির দিক খুলে দিগন্তে নতুন দিশার আলো দেখায়। বহু দেশ থেকে সংগৃহীত মানুষ, সমাজ, উপলব্ধি বন্দি হয় তার লেখনীর বিভিন্ন আঙ্গিকে। ব্যস্ততার মধ্যেও সময় খুঁজে নেয় নতুন চেতনার রচনাশৈলীতে। খুনের গল্পের বিবর্তন থেকে বৈজ্ঞানিক দর্শন তার লেখাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।
এই উপন্যাসটি প্রহেলিকা। ভিন্ন স্বাদের। বারবার নিজেকে ভাঙার মধ্যেই তার নতুনত্বের প্রকাশ। প্র্যাকটিসের বাইরে সেখানেই তার শান্তি। তার প্রতিটা উপন্যাস মৌলিক চিন্তাধারার ফসল। অনেক ক্ষেত্রে সাবেকিয়ানা ভেঙে বেরবার প্রয়াস। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সত্যকে নতুন করে খুঁজে চিনতে। তাকে লেখনীর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে।
লেখা তুমি আত্মদহনে জ্বলো
যদি নতুন সুরে, নতুন তানে না কিছু বলতে পার।
রবীন্দ্রসংগীত, ক্লাসিক্যাল সংগীতের অনুরাগী অনিরুদ্ধ বসুর শান্তির নীড় স্ত্রী স্মৃতি বসু।